চা বাগানেই ঘু‌মিয়ে আছেন ব্রিটিশ টি প্ল্যান্টাররা

বৃটেন থেকে কাজের সূত্রে এসেছিলেন সিলেট অঞ্চলের চা বাগানে। কাজের মধ্যেই তারা চলে যান পরলোকে। তারা শায়িত আছেন উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সিমেট্রিতে।
১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ শুরু হয়। ১৮৫৭ সালে সিলেট বিভাগে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়। জানা যায়, চা উৎপাদনের শুরু থেকেই ব্রিটিশরা এদেশে এসে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। পর্যায়ক্রমে সিলেট, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ ও হবিগঞ্জে চা বাগান গড়ে ওঠে।
শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চা বাগানে গিলবার্ড হেনরি টেট নামে এক ব্রিটিশ ‘টি প্ল্যান্টার’ চা চাষ শুরু করেন। ওই সময় ব্রিটেনের অনেক নাগরিক পরিবার-পরিজন ব্রিটেনে রেখে বাণিজ্যিকভাবে চা বাগানে চাকরিসূত্রে শ্রীমঙ্গলে আসেন। সেসময়ে অনেকেই এই অঞ্চলে মৃত্যুবরণ করেছেন, রাজঘাট চা বাগানে চাকরিসূত্রে এসে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদেরকে সমাহিত করা হয়েছে ডিনস্টন সিমেট্রিতে।
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে জেমস ফিনলে টি কোম্পানির ডিনস্টন চা বাগান। এখানেই শত বছরের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে ডিনস্টন সিমেট্রি। ডিনস্টন চা বাগানে চাকরি করার সময় গিলবার্ড হেনরি টেট ১৯৩৭ সালে মারা যান। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৫ বছর। স্ত্রী-ছেলে নিজ দেশে রেখে এখানে তিনি এসেছিলেন চা উৎপাদক হিসেবে। কয়েকবছর আগে গিলবার্ডের ছেলে পিটার বাবার সমাধি দেখতে প্রথমবারের মত আসেন বাংলাদেশে। তিনি শ্রীমঙ্গলের ডিনস্টন সিমেট্রিতে বাবার সমাধিতে নীরব সময় কাটিয়ে ফিরে যান।
ফিনলে টি কোম্পানীর সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার জি এম শিবলী জানান, ‘এই সিমেট্রিতে বিদেশিদের কবরের সংখ্যা ৪৬। ডিনস্টন সিমেট্রির ইতিহাস মনকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়! অনেক বিদেশি নাগরিক তাদের স্ত্রী-সন্তানকে রেখে চাকরি করতে এখানে এসেছিলেন। মৃত্যুর পর তাদের দেহ এখানেই সমাহিত করা হয়েছে।
এখানে আরও শায়িত রয়েছেন এক ব্রিটিশ দম্পতি ও ৯ শিশু। পাঁচটি সমাধিতে কোন নাম-পরিচয় উল্লেখ নেই। এই সিমেট্রিতে সমাহিতদের মধ্যে রয়েছেন রবার্ট রয়বেইলি, জর্জ উইলিয়াম পিটার ও মেরি এলিজাবেথ পিটার দম্পতি, এডওয়ার্ড ওয়ালেস। এছাড়াও হান্ট নামের একজন ব্রিটিশ নাগরিক কলেরায় আক্রান্ত হয়ে শ্রীমঙ্গল শহরে মারা যান, তাকেও এখানে সমাহিত করা হয়েছে। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকার একটি বিমান শমসেরনগর বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে শ্রীমঙ্গলের উদনাছড়া চা বাগানে বিধ্বস্ত হলে ওই বিমানের দু’জন চালক মারা যান। এই দু’জনের মরদেহও এই ডিনস্টন সিমেট্রিতে সমাহিত করা হয়।
সিমেট্রিতে নাম-পরিচয়হীন একটি সমাধিতে লেখা রয়েছে ‘In Loving Memory of my dearest husband’ —এই লেখার নিচেই লেখা রয়েছে জেসিজি।
জানা যায়, এই অঞ্চলে কর্মরত এক ব্রিটিশ নাগরিকের মৃত্যুর খবর শুনে নিহতের স্ত্রী জেসিজি তাৎক্ষণিকভাবে সুদূর ব্রিটেন থেকে শ্রীমঙ্গলে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে তার স্বামীর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়ে গেছে। তাই প্রিয়তমের কবরে নিজ হাতে তিনি লিখে যাওয়া বাক্যটি দর্শনার্থীদের হৃদয় স্পর্শ করে।
সিলেট অঞ্চলে আরও রয়েছে, লংলা চা বাগান সিমেট্রি, শমশের নগর সিমেট্রি, ডিনস্টন সিমেট্রি, বেগম খান সিমেট্রি, লালা খাল বা বাগান সিমেট্রি, মনিপুর চা বাগান সিমেট্রি, ফুলতলা টি এস্টেট, কাপনা পাহাড় চা বাগান সিমেট্রি, রাজকী চা বাগান সিমেট্রি।
কুলাউড়া শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ডানকান ব্রাদার্সের লংলা চা বাগানের রাবার বাগান এলাকায় রয়েছে ‘লংলা সিমেট্রি।’ এখানেও চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন টি প্লান্টার ও তাদের স্বজনরা। ব্রিটিশ নাগরিক ২৮ জনকে সমাহিত করা হয় লংলা চা বাগানের এই সিমেট্রিতে। এখানে অনেকগুলোতেই নেই শায়িতদের পরিচিতি, শুধু রয়ে গেছে মূল্যবান শ্বেত পাথরের কারুকার্যময় এপিটাফ।