বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সময় যেন দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আইনশৃঙ্খলা অবনতির পাশাপাশি সমন্বয়হীনতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং চুক্তি নিয়ে বিতর্ক—সব মিলিয়ে সরকার প্রশ্নের মুখে।
সঙ্কটে নেতৃত্ব ও জনআস্থা
সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সাফ জানিয়েছেন, এখনই এক্সিট পলিসি ও অর্জনের স্পষ্ট ঘোষণা দরকার। সরকারের গৃহীত সংস্কারগুলো কতটা স্বচ্ছ ও বৈধ হবে, তা ভবিষ্যতের সরকারের ওপর নির্ভর করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে, মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডসহ সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাগুলো জনমনে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ১৪১টি মব-সংক্রান্ত ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৮৩ জন। ধর্ষণের ঘটনাও ছিল উদ্বেগজনকভাবে বেশি।
অদৃশ্য শাসন ও সমন্বয়হীন প্রশাসন
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকারের ভিতরে ‘অদৃশ্য শক্তি’র প্রভাব বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, পাঠ্যবই পর্যালোচনা কমিটি কিংবা নারী অধিকার কমিশনের সুপারিশ—সব ক্ষেত্রেই দ্বিধা, মতবিরোধ এবং সিদ্ধান্তহীনতা লক্ষণীয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনা, খাদ্য ও পণ্যের দাম বৃদ্ধি, বেকারত্ব এবং দুর্নীতির অভিযোগে সরকার ক্রমশ জনআস্থা হারাচ্ছে। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, গত এক বছরে প্রায় ২৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।
চুক্তি ও আন্তর্জাতিক বিতর্ক
ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপন, এনডিএ, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা এবং মার্কিন শুল্ক ইস্যুতে সরকার তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। সরকারের বক্তব্য—সব চুক্তি জনগণের স্বার্থেই করা হয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, সরকারের বৈধতার প্রশ্ন থেকেই যায়।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার বারবার ‘সংস্কার’ আর ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য’-র কথা বললেও নির্বাচন প্রসঙ্গে এখনো কোনো পরিষ্কার রূপরেখা দেয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন ছাড়া সংকট নিরসনের সুযোগ নেই।
বিএনপি, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দলের নেতারা সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, সরকার যদি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট ঘোষণা না দেয়, তাহলে নতুন করে রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হবে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন
সুপ্রিম কোর্টের একাধিক আইনজীবী বলছেন, বিচারকরা এখন সিদ্ধান্ত দিতে ভয় পাচ্ছেন। রাজনীতির প্রভাব ও শঙ্কার কারণে বিচারপ্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যারিস্টার সারা হোসেনও জানিয়েছেন, ভয়ভীতির মধ্যে দেশের বিচারব্যবস্থা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।
আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ সংকট
ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা এনসিপিসহ সংশ্লিষ্ট ছাত্রসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, প্রতারণা এবং নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে আন্দোলনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এসব অভিযোগ তদন্তে দুদককে আহ্বান জানিয়েছে রাজনৈতিক মহল।
পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এক-এগারোর ছায়া?
২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত সরকারের মতোই, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী কণ্ঠ দমন, সংস্কারের নামে গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়ন এবং নির্বাচনী রূপরেখার অভাবের অভিযোগ উঠছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ইতিহাস হয়তো আবারও নিজেদের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে।