সংস্কার নিয়ে সংলাপে বসছে সরকার

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে গঠিত ছয় কমিশনের কাজের অগ্রগতি জানাতে আগামী শনিবার থেকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে বসবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে কমিশনের সদস্য কারা হবেন, তা সংলাপে নয়; সরকারই ঠিক করবে। দলগুলোকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে নেওয়া হবে পরামর্শ।

গতকাল বুধবার রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংলাপের বিষয়ে অবহিত করেন।

সূত্র জানায়, পর্যায়ক্রমে হতে পারে সংলাপ। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী আমন্ত্রণ পেয়েছে। অন্যান্য দল গতকাল রাত পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পায়নি। বিএনপিকে শনিবার সকালে এবং জামায়াতকে বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

শুধু সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি জানানোর আমন্ত্রণে রাজনৈতিক দলগুলো সন্তুষ্ট নয়। সূত্র জানায়, কমিশনের প্রধান নিয়োগে সরকার মতামত নেয়নি। সদস্য বাছাইয়েও তাদের ‘একলা চলো নীতি’ দূরত্ব সৃষ্টি করছে। সরকারের এ কর্মপদ্ধতি কালক্ষেপণ বলে মনে করছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল।

গত মঙ্গলবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও একই সুর ছিল। দলটির নীতিনির্ধারক নেতারা বৈঠকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সংলাপ ভালো উদ্যোগ। কিন্তু সরকারের কথা ও কাজে মিল থাকছে না, যা উদ্বেগের।

অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটি সংলাপে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ জানিয়েছেন, শনিবার বিকেল ৩টায় তাদের ডাকা হয়েছে। জামায়াত অংশ নেবে।

জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির একটি ছোট দল অংশগ্রহণ করবে। তবে সেখানে দু-একজন বিশেষজ্ঞও থাকতে পারেন। এ দলে কারা কারা থাকবেন, তা এখনও চূড়ান্ত করেনি দলটি।

সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি জানাতে সংলাপে খুশি নয় বিএনপি। দলটির নেতাদের বক্তব্যে তা স্পষ্ট। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, ‘সংলাপ তো আর এজেন্ডা নির্ধারণ করে হয় না। অন্তর্বর্তী সরকার হয়তো সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরবে। কিন্তু বিএনপিরও তো বক্তব্য আছে, অনেক বিষয় আছে। সেগুলো অবশ্যই উপস্থাপন করব, বলব।

গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. ইউনূস নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন এবং কমিশনপ্রধানদের নাম জানান। ১ অক্টোবর থেকে কমিশনগুলোর কাজ শুরুর কথা থাকলেও তা হয়নি। কমিশনে এখন পর্যন্ত সদস্যও নিয়োগ হয়নি।

গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছিলেন, ছয় সংস্কার কমিশন পুরোদমে কাজ শুরুর আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, আলোচনার মুখ্য বিষয় হবে ছয় সংস্কার কমিশনের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবহিত করা। এ ছাড়া দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও কথা হবে এবং তাদের পরামর্শ নেওয়া হবে।

কমিশন গঠন সংলাপের আগে হতে পারে কিনা– প্রশ্নে প্রেস সচিব বলেন, কমিশন গঠন রাজনৈতিক দলের আলোচনার ওপর নির্ভর করছে না। কমিশনগুলোর প্রধানরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। কার্যপরিধিও নির্ধারিত হয়েছে। তাদের জন্য কার্যালয়ও খোঁজা হচ্ছে। কমিশনের যারা সদস্য হবেন, তাদের সম্মতি নেওয়া হচ্ছে; তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা হচ্ছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কত দিন আলোচনা হবে, তা আপাতত বলতে পারছেন না শফিকুল। কোন কোন দলকে আমন্ত্রণ জানানো হবে– প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা নির্ভর করছে প্রধান উপদেষ্টার ওপর। উপদেষ্টা পরিষদই সিদ্ধান্ত নেবে। যতটুকু জেনেছি, প্রধান প্রধান দলকে দাওয়াত দেওয়া হবে।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ দায়িত্ব পেয়েছেন। যদিও শুরুতে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয় ড. শাহ্‌দীন মালিককে। ব্যক্তিগত কারণে দেখিয়ে দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশের পর তাঁর পরিবর্তে আলী রীয়াজকে দায়িত্ব দেয় সরকার।

জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন, কমিশনের অন্য সদস্যদের নাম কমিশনপ্রধানদের সঙ্গে আলোচনায় ঠিক করা হবে। কমিশনগুলোর আলোচনা ও পরামর্শ সভায় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ছাত্র-শ্রমিক-জনতা আন্দোলনের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষ্য, তাদের অভিমত নেওয়া হয়নি সদস্য নিয়োগে। সরকার কার কার পরামর্শ নিয়েছে, তাও স্পষ্ট নয়। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে শফিকুল আলম এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, উপদেষ্টা পরিষদ বিপ্লবকে রিপ্রেজেন্ট করে। তারা জনগণের সরকার।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার গত ১২ আগস্ট প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে। দ্বিতীয় দফায় ২৯ ও ৩১ আগস্ট সংলাপ করে সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাষ্য, ১৫ আগস্টের ছুটি বাতিল ছাড়া আগের দুই সংলাপে তোলা কোনো দাবি কিংবা পরামর্শের বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবি পূরণ হয়নি। যদিও সরকারি ভাষ্য, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশনগুলো জানাবে, কী কী সংস্কার করতে হবে। এরপর দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে ঠিক হবে কীভাবে সংস্কার হবে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সর্বাত্মক অংশ নেওয়া একটি দলের সদস্য সচিব বলেন, সরকার ধারাবাহিকভাবে দলগুলোর সঙ্গে বসবে জেনেছি। সরকার যদি কমিশন গঠনে রাজনৈতিক মতামত গ্রহণ না করে, তবে সংলাপ সময়ক্ষেপণ ছাড়া কিছুই নয়। এতে অনাস্থা সৃষ্টি হবে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাজাহান বলেছেন, দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ মনে করছি সংলাপকে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে চেতনা ও দেশপ্রেম মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয়েছে, যেভাবে দেশকে সংস্কার করার দাবি উঠেছে, সংলাপের মাধ্যমে তা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, সংস্কারের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান অংশীজন। তাদের মতামত নিয়ে এগোলে সংস্কারের প্রক্রিয়া ইনক্লুসিভ হবে।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে সব বিষয়ে সরকারের সুরে কথা বলে ফ্যাসিবাদের দোসর তকমা পাওয়া জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু জানিয়েছেন, এখনও সংস্কারের আমন্ত্রণ পাননি। পেলে জাপা অংশ নেবে। সংস্কারে জাপা সরকারকে সহযোগিতা করতে চায়। সরকারকে এ কাজে সময় দেওয়া প্রয়োজন।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সংলাপ আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আগের বৈঠকে যে ধরনের সংলাপ আয়োজনের প্রস্তাব করেছিলাম, তা হবে বলে মনে হয় না। এবারের সংলাপে নির্বাচনসহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে না। প্রতিটি দলের জন্য আধা ঘণ্টা বরাদ্দ করা হয়েছে। সেখানে সরকার তাদের দুটি এজেন্ডা রেখেছে। আধা ঘণ্টায় কোনো পক্ষেরই অবস্থান তুলে ধরা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, প্রথম থেকেই বলে আসছি– সংস্কারের বিষয়ে কী হচ্ছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলা দরকার। এখন যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা ইতিবাচক। প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে তো সেই আগস্টের পর আর দেখাই হয়নি।