
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তঘেঁষা এক পাহাড়ি গ্রাম—সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার ঝুমগাঁও। প্রকৃতি ও পরিচ্ছন্নতার অসাধারণ সমন্বয়ই এই ছোট্ট আদিবাসী গ্রামটিকে করে তুলেছে দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে খ্যাত।
প্রায় ১০০ ফুট উঁচু পাহাড়ি টিলায় অবস্থিত এ গ্রামে রয়েছে প্রায় ৪০টি খাসিয়া আদিবাসী পরিবার। চারদিকে সবুজের চাদরে মোড়া টিলা, ঝিরি ঝিরি পাহাড়ি ঝরনা, আর ফুলে-পাতায় রঙিন পথঘাট—সব মিলিয়ে ঝুমগাঁও যেন প্রকৃতি আর সংস্কৃতির জীবন্ত চিত্রপট।
ঝুমগাঁও যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি সুনামগঞ্জ যেতে পারেন সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে। মামুন, শ্যামলী, হানিফ, এনা ইত্যাদি বাস সার্ভিসে টিকিট পাবেন ৭০০–৮০০ টাকার মধ্যে। সময় লাগবে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা।
অন্য বিকল্প হলো ট্রেনে কমলাপুর থেকে সিলেট, তারপর বাসে সুনামগঞ্জ।
সুনামগঞ্জ শহর থেকে আজমপুর ফেরিঘাট যেতে পারেন সিএনজি বা মোটরসাইকেলে (ভাড়া ১৫০ টাকা)। ফেরিতে সুরমা নদী পার হতে সময় লাগে প্রায় ৩০ মিনিট। এরপর দোয়ারাবাজার শহর থেকে মোটরসাইকেল বা সিএনজিতে ৪০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছাবেন ঝুমগাঁও।
ঝুমগাঁও গ্রামে যা দেখবেন
ঝুমগাঁও গ্রামে ঢুকলেই চোখে পড়বে ফুলে-পাতায় রঙিন পথ।
লাল, সবুজ, হলুদ ও গোলাপি পাতাবাহার গাছ, আদিবাসী নারীদের বাগানে সাজানো টব, ঘরের বারান্দায় ঝুলে থাকা ফুলের ঝাড়—সব মিলিয়ে গ্রামটি যেন প্রকৃতির রঙতুলি দিয়ে আঁকা এক জীবন্ত পেইন্টিং।
গ্রামের উত্তর-পূর্ব পাশে রয়েছে ১৫০ ফুট উঁচু সিঁড়ি, যেটা বেয়ে উঠলে ওপরে চোখে পড়ে সীমান্তপিলার এবং ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি দৃশ্য। এখানেই রয়েছে শতবর্ষ পুরনো মাটির ঘর, যা এখনও আদিবাসী সংস্কৃতির নিদর্শন বহন করে।
আরও একটু এগোলে দেখা মিলবে একটি ঝিরি ঝরনার, যেটির পানি বর্ষায় সবুজাভ রূপ নিয়ে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসে। এই পানিতেই গোসল করেন স্থানীয়রা। তবে এখানে ছবি তোলা নিষিদ্ধ, কারণ পাশে রয়েছে বিএসএফ-এর স্থায়ী চৌকি।
খাবার ও থাকা
গ্রামে কোনো হোটেল বা গেস্টহাউস নেই। তাই দিনভর ঘুরে এসে থাকতে হবে সুনামগঞ্জ বা সিলেট শহরে। সেখানে ৫০০–২০০০ টাকায় ভালো মানের আবাসিক হোটেল পাওয়া যায়।
দুপুরের খাবারের জন্য ফিরতে হবে বাংলাবাজারে, যেখানে জনপ্রতি ২০০–২৫০ টাকায় গরু, খাসি, মাছ ও পাহাড়ি সবজির সুস্বাদু খাবার পাবেন।
কিছু দায়িত্ব ও সতর্কতা
গ্রামে পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট ডাস্টবিন রয়েছে—সেখানে ময়লা ফেলুন।
ফুল, গাছ, ফল ছিঁড়বেন না।
স্থানীয় আদিবাসীদের প্রতি সম্মানবোধ রাখুন।
বিএসএফ পোস্টের আশপাশে ছবি তোলা একেবারেই নিষিদ্ধ।
ঝুমগাঁও: পরিচ্ছন্নতার প্রতীক
বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামে যেখানে প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট পড়ে থাকে হাটবাজারে, সেখানে ঝুমগাঁও গ্রামের প্রতিটি পথেই থাকে ঝাড়ু দেওয়া, ফুলে সাজানো পাথরপথ। গ্রামের শিশুরাও জানে কোন জিনিস ময়লা এবং কোনটা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
এ গ্রাম আমাদের শেখায়—পরিচ্ছন্নতা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি একটি সংস্কৃতি, একটি মানসিকতা। চাইলে আমরাও পারি আমাদের চারপাশকে এমন পরিচ্ছন্ন ও মনোমুগ্ধকর করে তুলতে।