
আজকের বিশ্বে যখন ইসলাম ও মুসলমানদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের প্রবণতা বাড়ছে—মতাদর্শিক বিভ্রান্তি, পক্ষপাতদুষ্ট মিডিয়া চিত্র ও রাজনীতিক প্রোপাগান্ডার ছায়ায়—তখন ইতিহাসের পাতায় ফিরে তাকালে এক বিস্ময়কর বাস্তবতা ধরা পড়ে। সেটা হলো—বিশ্বসভ্যতার উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে মুসলিমদের অসামান্য ও অমলিন অবদান।
ইসলামী সভ্যতা কেবল ধর্মীয় অনুশাসনভিত্তিক সংস্কৃতি নয়, বরং এটি এক পূর্ণাঙ্গ মানবিক উন্নয়নের প্রতীক, যার পরিধি ছুঁয়ে গেছে জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, দর্শন, শিল্প-সাহিত্য, প্রযুক্তি ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা—সমস্ত কিছু।
শিক্ষা ও গবেষণায় ইসলামের অনুপ্রেরণা
“পড়ো”—এই শব্দটি দিয়েই কোরআনের প্রথম ওহি শুরু। এর মাধ্যমে ইসলামে জ্ঞানের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আদর্শ ধারণ করেই মুসলিমরা এক অনন্য শিক্ষানুরাগী জাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়। বাগদাদ, কর্ডোভা, নিশাপুর কিংবা কায়রোর লাইব্রেরিগুলো হয়ে ওঠে জ্ঞানের তীর্থস্থান।
শুধু ধর্মীয় জ্ঞান নয়—মুসলিম পণ্ডিতরা গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ভূগোল, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দার্শনিক চিন্তায় রেখে যান অবিস্মরণীয় অবদান। মুসলিমরাই প্রথম গবেষণায় পরীক্ষামূলক পদ্ধতির (Scientific Method) প্রবর্তন করেন, যা আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি।
চিকিৎসায় মুসলিম মনীষীদের বিপ্লব
“আল্লাহ এমন কোনো রোগ দেননি, যার প্রতিকারও দেননি”—এই হাদিসের আলোকে মুসলমান চিকিৎসাবিদরা চিকিৎসাকে কেবল পেশা নয়, ইবাদতের অংশ হিসেবে বিবেচনা করতেন।
বিশ্বের প্রথম আধুনিক হাসপাতালগুলো—বিমারিস্তান—প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুসলমানরা। এতে ছিল বিনামূল্যে চিকিৎসা, ওষুধ বিতরণ, মানসিক রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড, এমনকি নারী চিকিৎসার জন্য নারী চিকিৎসক।
ইবনে সিনা, আল রাজি, জাহরাবি, ইবনু নাফিস—প্রত্যেকে একেকটি ইতিহাস। ইবনে সিনার ‘আল-কানুন ফি তিব্ব’ সাত শতাব্দী ধরে ইউরোপে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হয়। আল রাজি রচনা করেন বিশ্বখ্যাত ‘আল-হাওয়ি’। জাহরাবিকে বলা হয় আধুনিক অস্ত্রোপচারের জনক, আর ইবনু নাফিস প্রথম রক্ত সঞ্চালনের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন।
বিজ্ঞানে মুসলিমরা অগ্রদূত
আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অনেকেই মুসলিম মনীষী। গণিতে আল-খোয়ারিজমির নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল। তাঁর ‘আল-জাবর ওয়াল মুকাবালাহ’ থেকেই এসেছে ‘Algebra’। তাঁর নাম থেকেই জন্ম ‘Algorithm’ শব্দের, যা বর্তমান কম্পিউটারবিজ্ঞানের মেরুদণ্ড।
জ্যোতির্বিদ্যায় আল-ফারগানি ও আল-বিরুনির কাজ, ভূগোলে ইদরিসি ও মাসউদির মানচিত্র, রসায়নে জাবির ইবনে হাইয়ানের সূত্র, এমনকি ঘড়ি ও জ্যোতির্বিষয়ক যন্ত্রের উদ্ভাবন—সবকিছুই আধুনিক বিজ্ঞানের মঞ্চ প্রস্তুত করে দেয়।
একটি সভ্যতার প্রাসঙ্গিকতা
ইসলামী সভ্যতা শুধু অতীত গৌরব নয়; এটি একটি জ্যান্ত, বাস্তব, মানবিক এবং সমন্বিত জীবনব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। এটি আজও বিশ্বে ন্যায়বিচার, গবেষণা, সংস্কৃতি ও মানবিক নেতৃত্বের জন্য একটি সময়োপযোগী আদর্শ হতে পারে—যদি ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়।
আল্লাহ বলেন—
“তোমরা সেই শ্রেষ্ঠ জাতি, যাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য।”
(সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)
উপসংহার
আজকের মুসলিম বিশ্ব প্রযুক্তিতে হয়তো পিছিয়ে, কিন্তু ইতিহাসের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে এখনো ভবিষ্যতের পথ তৈরি করা সম্ভব। ইতিহাসের এ আলো কোনো জাতির নয়, এটি মানবতার জন্য এক মহান দ্যুতি।
এম ওয়াই/ বাঁশখালী প্রতিদিন