সামাজিক ব্যবসা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে

সাভারে সোশ্যাল বিজনেস ডে’র উদ্বোধনে প্রধান উপদেষ্টা । পৃথিবীতে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার একমাত্র সঠিক পথ সামাজিক ব্যবসা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং সামাজিক ব্যবসা ধারণার জনক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সামাজিক ব্যবসার এক অপার শক্তি রয়েছে, যা কেবল বাংলাদেশকে নয়, পুরো বিশ্বকে বদলে দিতে পারে। তিনি সামাজিক ব্যবসার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে একটি সুন্দর ও উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব বলে মন্তব্য করে বলেন, যা এই বিশ্বকে বর্তমানের হতাশা থেকে মুক্তি এনে তাৎপর্যপূর্ণ রূপান্তর ঘটিয়ে নতুন সভ্যতাও তৈরি করতে পারে। গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকার অদূরে সাভারের জিরাবো সামাজিক কনভেনশন সেন্টারে দুদিনব্যাপী সোশ্যাল বিজনেস ডে’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব বলেন। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসা সর্বোত্তম পন্থা’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারের সোশ্যাল বিজনেস ডে উদযাপন করা হচ্ছে।

অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পৃথিবীতে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার একমাত্র সঠিক পথ হলো সামাজিক ব্যবসা। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব। এবারের সম্মেলনে বিশ্বের ৩৮টি দেশ থেকে এক হাজার ৪০০ জনের বেশি প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। ইউনূস সেন্টার ও গ্রামীণ গ্রুপ আয়োজিত ১৫তম সামাজিক ব্যবসা দিবসের অনুষ্ঠানের প্রথম দিনের শুরুতে জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। এরপর পরিবেশন করা হয় মনোমুগ্ধকর লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

প্রধান উপদেষ্টা আবেগঘন বক্তব্যে সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন, বিশ্ব একটি ভুল পথে চলছে এবং কেবল নিঃস্বার্থ, ভালো কাজের জন্য স্বপ্নবান হওয়া এবং সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি বলেন, আমরা ভুল পথে চলছি, যেটি শেষ হবে ধ্বংসের মধ্য দিয়ে। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব, ডোনেশনের মাধ্যমে নয়। অধ্যাপক ইউনূস তরুণদের বৈশ্বিক পরিবর্তন আনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, উদ্যোক্তা হিসেবে ছোট থেকে শুরু করতে হবে, বড় স্বপ্ন দেখতে হবে এবং একসঙ্গে কাজ করে এমন একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে, যার বৈশিষ্ট্য হবে তিনটি শূন্য ‘শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণ’।

চাকরি প্রার্থী নয়, উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করার মতো শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রথম দিন থেকেই যেন জানে তারা চাকরির জন্য এখানে আসেনি। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্রদের স্বপ্ন দেখতে দেওয়া হয় না। আমি বলি, শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম দায়িত্বই হলো স্বপ্ন দেখার সুযোগ দেওয়া। ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আগে স্বপ্ন দেখতে হবে। তারপর কীভাবে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায় সেই পথ খুঁজে বের করো। একে অপরকে চ্যালেঞ্জ দাও। এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে সোশ্যাল বিজনেস শিক্ষার গুরুত্ব আমাদের কাছে এত বড়।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তরুণদের বলব, যদি তুমি একজন চাকরি প্রার্থী হও, তবে সেটি আমাদের জন্য লজ্জার। কারণ আমরা তোমাকে নিজেকে আবিষ্কার করার মতো সাহায্য করতে পারিনি। যদি তুমি নিজেকে আবিষ্কার করো তাহলে কখনোই চাকরি প্রার্থী থাকবে না। তুমি একজন উদ্যোক্তা হয়ে উঠবে। চাকরি খোঁজার জন্য অসীম ক্ষমতার মানুষের সৃষ্টি হয়নি।

ভারত–পাকিস্তান, ইরান–ইসরায়েল–ফিলিস্তিন এবং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই বছরের প্রেক্ষাপট অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে খারাপ। আগের সোশ্যাল বিজনেস ডে’গুলোতে আমরা অনুভব করতাম যে, পৃথিবী একটা আশাব্যঞ্জক দিকে এগোচ্ছে। আমরা ভেবেছিলাম, বিশ্বে যুদ্ধের অধ্যায় শেষ হচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম মানব জাতি এখন শান্তিতে বাস করবে। কিন্তু হঠাৎ করেই এ বছর নানা ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে শুরু করল। দরিদ্র মানুষ এই যুদ্ধে পিষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেছেন, যুদ্ধ সংঘাতে হতাশ পৃথিবী পিছিয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত। তাই স্বার্থপরতা ভুলে নতুন করে বিশ্ব বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে।

তিনি বলেন, সামাজিক ব্যবসার একটি বার্তা হলো পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার বার্তা এবং এর জন্য প্রয়োজন প্রতিটি জাতির অংশগ্রহণ। প্রতিটি জাতির উচিত সেইসব সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা, যেগুলো তারা এত বছর ধরে তুলে ধরেছে। তিনি বলেন, এবং এই বার্তাটি খুবই সহজ, যা আমরা বারবার পুনরাবৃত্তি করে আসছি। বার্তাটি হলো, আমরা ভুল পথে চলছি। যদি আমরা এই পথেই এগিয়ে যেতে থাকি, তাহলে আমাদের সবার জন্যই এক বিশাল বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। আমরা তার থেকে রক্ষা পাব না।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, অন্য একটি পথ অনুসরণ করার খুবই সহজ উপায় রয়েছে এবং এর জন্য সবকিছু রাতারাতি ধ্বংস করার প্রয়োজন নেই। আপনি কেবল ধীরে ধীরে ভিন্ন এক পথে হাঁটতে শুরু করুন। ব্যস, এটাই। এটা খুবই বাস্তবসম্মত এবং সহজে বাস্তবায়নযোগ্য।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা বারবার বিশ্বকে যা বোঝাতে চেয়েছি তা হলো পুরো পৃথিবী গড়ে উঠেছে মানুষের স্বার্থপরতার একমাত্রিক ভিত্তির ওপর এবং মানুষকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে স্বার্থপর সত্তা হিসেবে। আমরা এর বিরোধিতা করছি। আমরা বলছি, হ্যাঁ, আমাদের ভেতরে স্বার্থপরতা আছে। তবে এটাও ভুলে যাবেন না যে, আমাদের ভেতর নিঃস্বার্থ মানসিকতাও আছে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সামাজিক ব্যবসা দিবস এক ধরনের পারিবারিক মিলনমেলা, যেখানে সবাই একত্রিত হন পরিবারের সদস্যদের মতো। তিনি বলেন, আপনাদের সবার অনেক গল্প আছে বলার মতো। আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নয়, বরং নিজেদের অনুপ্রাণিত করার জন্য। আমরা সবসময় আমাদের সামাজিক ব্যবসা দিবসকে একটি উপলক্ষ হিসেবে দেখি, যেখানে আমরা নিজেদের শক্তি পুনরায় আহরণ করি।

তিনি বলেন, বিশ্বের হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ অসাধারণ কিছু করেছে। তরুণরা আশ্চর্যজনক সব কাজ করেছে। তারা রাস্তায় নেমে এসেছে এবং বলেছে, এবার যথেষ্ট হয়েছে। তরুণরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই দেশকে চরম অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে গেছে। তারা শুধু বাংলাদেশের জন্যই এটা করেনি; এটি ছিল পুরো বিশ্বের জন্য। বাংলাদেশ শুধু নিজের ইতিহাস নয়, বরং পুরো বিশ্বের জন্য একটি ইতিহাস হয়ে উঠবে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তরুণরা বিশ্বজুড়েই একই কাজ করতে পারে। যথেষ্ট হয়েছে। সরে দাঁড়ান। আপনারা আমাদের জন্য যথেষ্ট সমস্যা তৈরি করেছেন। এখন পৃথিবীকে নিজের মতো করে বিকশিত হতে দিন। আমরা আমাদের জন্য একটি নতুন পৃথিবী গড়ে তুলব–এটাই আমাদের অঙ্গীকার। আমরা একটি নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে চাই এবং আমরা তা পারি। বিগত সরকারের আপত্তি থাকায় সামাজিক ব্যবসা দিবস পালন করা সম্ভব হয়নি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতি থমাস বাখের একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়, যেখানে অধ্যাপক ইউনূসের সামাজিক ব্যবসা আন্দোলনের গভীর প্রভাবের প্রশংসা করেন তিনি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গ্যুইন লুইস, জাপানের ইউগ্লিনা জিজি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা মিৎসুরু ইজুমো, বিশ্বব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও এনজিআইসির সহসভাপতি ইসমাইল সেরাগেলদিন, গ্রামীণ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আশরাফুল হাসান, ইউনূস সেন্টারের জনসংযোগ অফিসার জিনাত ইসলাম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

পরে ড. ইউনূস সামাজিক ব্যবসা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত মেলার বিভিন্ন স্টল পরিদর্শন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তা, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং বিদেশি অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।