ইলেকটোরাল কলেজ জয়-পরাজয়

নির্বাচনে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন, তিনিই যে জয়ী হবেন; এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। দেশটির ভোটাররা সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন না। ইলেকটোরাল কলেজ নামের এক পদ্ধতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
কী এই ইলেকটোরাল কলেজ : যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের একটিতে জয়ী হওয়ার অর্থ একজন প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সবকটি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়ে যাবেন। দেশটির মোট ইলেকটোরাল কলেজের সংখ্যা ৫৩৮। মেইন ও নেব্রাসকা এ দুটি অঙ্গরাজ্য বাদে বাকি সব রাজ্যের ইলেকটোরাল কলেজ ভোট যোগ দিলে যে প্রার্থী ২৭০টি বা তারও বেশি ভোট পাবেন, তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। সাধারণত প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের বেশ কয়েকটি করে ইলেকটোরাল ভোট থাকে, যা ওই অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার মোটামুটিভাবে সমানুপাতিক হয়। ক্যালিফোর্নিয়াতে আছে সর্বাধিক ৫৪টি এবং ভায়োমিং, আলাস্কা ও নর্থ ডাকোটার (ওয়াশিংটন ডিসি) মতো যেসব অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যা খুবই কম, তাদের আছে তিনটি ইলেকটোরাল ভোট। ধরা যাক, টেক্সাসে একজন প্রার্থী ভোটারদের সরাসরি ভোটের ৫০.১ শতাংশ পেয়েছেন, তখন ওই অঙ্গরাজ্যের ৪০টি ইলেককোরাল ভোটের সব সেই প্রার্থী পেয়ে যাবেন। একটি অঙ্গরাজ্যে জয়ের ব্যবধান যদি বিরাট হয়ও, তাহলেও জয়ী প্রার্থী অত ইলেকটোরাল ভোটই পাবেন।
এ নিয়মেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ কম ভোট পেয়েও তাকে পরাজিত করেছিলেন। জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০০ সালে আল গোরকে পরাজিত করেছিলেন, যদিও সাধারণ ভোটে তার জয়ের ব্যবধান ছিল পাঁচ লাখেরও বেশি।
একেক রাজ্যের হাতে একেক সংখ্যক ভোট থাকার কারণে প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচার এমনভাবে পরিকল্পনা করেন যাতে করে বেশি ভোট আছে এমন রাজ্যগুলো প্রাধান্য পায়।
ইলেকটোরাল কলেজ কেন বলা হয় : কলেজ শব্দটির অর্থ এখানে সেই ব্যক্তিদের বোঝানো হয়, যারা একটি অঙ্গরাজ্যের ভোট দেওয়ার অধিকারী। ইলেকটোরাল কলেজ হচ্ছে কর্মকর্তাদের একটি প্যানেল, যাদের ইলেকটরস বলা হয়। এরা আসলে নির্বাচকমণ্ডলী। প্রতি চার বছর পরপর এটি গঠন করা হয় এবং এরাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টকে বাছাই করেন।
কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে প্রতিটি স্টেটের ইলেকটরসের সংখ্যা নির্ধারিত হয়। আবার নির্ধারিত হয় স্টেটে সেনেটরের সংখ্যা (প্রত্যেক স্টেটে দুজন) এবং প্রতিনিধি পরিষদে প্রতিনিধির (যা জনসংখ্যার অনুপাতে) যোগফল মিলিয়ে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে প্রার্থী অঙ্গরাজ্যে জয়ী হবেন, তাকেই কি ভোট দিতে বাধ্য নির্বাচকরা? কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে নির্বাচকদের সে স্বাধীনতা আছে। তারা সাধারণ ভোটাররা কাকে পছন্দ করেছেন, তার ওপর নির্ভর না করে নিজের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। তবে দেখা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেয়েছেন যে প্রার্থী, তাকেই নির্বাচকরা ভোট দিয়েছেন।
অঙ্গরাজ্য থেকে যাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে, তার বিরুদ্ধে যদি কোনো নির্বাচক ভোট দেন, তাকে ফেইথলেস বা অবিশ্বাসী বলা হয়। কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে ফেইথলেস নির্বাচকদের জরিমানা করা বা মামলা দেওয়া হতে পারে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে এভাবেই সাতটি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট দেওয়া হয়েছিল, তবে নির্বাচনের ফলাফলে তার কোনো প্রভাব পড়েনি।
ইলেকটোরাল ভোটে টাই হলে কী হবে : যদি স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা কেউ না পান, সে ক্ষেত্রে মার্কিন আইন সভার নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভস ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। মাত্র একবারই এটি হয়েছে ১৮২৪ সালে। ইলেকটোরাল কলেজের ভোট চারজন প্রার্থীর মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ায় কেউই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি।
ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি কেন : ১৭৮৭ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লেখা হয়, তখন বিশাল দেশটিতে যোগাযোগের অভাবে জাতীয় স্তরে সাধারণ মানুষের ভোট নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা কার্যত অসম্ভব ছিল। তখন সংবিধান রচয়িতারা ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। সংবিধান প্রণেতারা ১৭৮৭ সালে সংবিধান রচনার সময় কংগ্রেস এবং জনগণের সরাসরি ভোটে (পপুলার ভোট) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই পদ্ধতি বাতিল করে দেন। তাদের যুক্তি ছিল, পপুলার ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে মানুষ তাদের স্থানীয় প্রার্থীকে ভোট দেবে এবং তার ফলে বড় রাজ্যগুলো আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে।
ছোট ছোট রাজ্যগুলো এই ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিকে সমর্থন করে কারণ এর ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এ পদ্ধতির পক্ষ নেয় কারণ সে সময় এসব রাজ্যে দাসের সংখ্যা ছিল অনেক। দাসদের ভোটাধিকার না থাকা সত্ত্বেও আদমশুমারিতে তাদের গণনা করা হতো।
এ ছাড়া সংবিধান রচয়িতারা চাননি যে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে শুধু আইন প্রণেতারা দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করুক।